সহজ জীবন
SAHAJA JIBAN
পরম পূজ্যা শ্রী মাতাজী নির্মলা দেবী প্রণীত
সহজযোগ পরিচয়
মানুষ নিজের আনন্দ ও সুখের অন্বেষণে সত্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে , সে ক্রমশ ই ভুলে যাচ্ছে যে প্রকৃত আনন্দ ও সুখ শান্তির উৎস তারই মধ্যে স্থিত । অর্থ সম্পত্তি , অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তার, পার্থিব ক্ষমতা অথবা স্বার্থ যুক্ত ভালবাসার মাধ্যমে যে সুখ লাভ করা যে সম্ভব নয়, সে কথা সে বুঝতে পারে না । অবশেষে সে ধর্মের আচার অনুষ্ঠান কেই আশ্রয় করে । ফলে শুরু হয় এক ধর্মের সাথে অপর ধর্মের দ্বন্দ। কিন্তু সকল ধর্মের মুলেই বলা হয়েছে যে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন ঘটাতে হবে ।এই পরম সত্য কে আজ আমরা বিস্মৃত হতে চলেছি। তাই প্রয়োজন হল মানুষের চিত্তকে অন্তরাভিমুখি করা ।
আমাদের অন্তরাত্মা আমাদের চৈতন্য একটি শক্তি যাকে ঐশ্বরিক প্রেমের শক্তি বলা যেতে পারে। সত্যের অপর একটি দিক হলো এই যে এক মহৎ তম দিব্য প্রেম শক্তি দিয়ে যাবতীয় বিবর্তন এবং সকল পার্থিব ও শক্তি বহিঃপ্রকাশ অতি সুন্দর ভাবে পরিচালিত হয়ে চলেছে। এই বৃহৎ প্রেম শক্তি যে কত সচেতন এবং কত ক্ষমতার অধিকারী সে ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। শুধু তাই নয় আমরা এমন ভাবে তার কার্যকারিতা কে গ্রহণ করি যে, আমরা ভুলে যাই এই শক্তি কত ব্যাপক, নির্মল, সূক্ষ্ম ও সতস্ফুর্ত। দুঃখের বিষয় এই যে এই বৃহৎ শক্তি কে আমরা কখনোই সচেতনতা আর মানবিক স্তরে অনুধাবন করতে পারিনা। তার জন্য বিবর্তনের এক উচ্চ স্তরে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র তাই আত্ম সাক্ষাৎকার লাভের পর এই সাধক আপন শরীরে শীতল শান্ত স্পন্দন হিসাবে এই প্রেম শক্তিকে অনুভব করে থাকে। এই স্তরে সাধকের চিত্ত এক অন্তর্লীন আনন্দময় নৈঃশব্দের জগতে প্রবেশ করে এবং আত্মমুখী হয়ে ওঠে। নিঃসংশয় আমরা এই সব কিছুকে সত্য সন্ধানী মানুষ হিসাবে পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রমাণসাপেক্ষ ধারণা হিসেবে গ্রহণ করব এবং বিশদ পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে এটি সত্য বলে প্রমাণিত হলে সততার জন্যই আমরা তাকে গ্রহণ করব। কারণ একমাত্র এরই মাধ্যমে মানুষের যাবতীয় সমস্যা দূর করা সম্ভব। এই পবিত্র জ্ঞান আমাদের কৃষ্টির কৃষ্টির মূল যা প্রাচীন যুগে ভারতবর্ষে সাধুসন্ত ঋষিদের অর্জিত বিদ্যা ।
কুণ্ডলিনী ও আত্ম সাক্ষাৎকার লাভ
ঈশ্বরের এই প্রেম শক্তি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে । আমাদের মেরুদন্ডের সর্বনিম্ন অংশে ত্রিকোণাকার অস্থিতে এই শক্তি সাড়ে তিন কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে । তাই এর নাম কুণ্ডলিনী। বহু যুগ আগে গৃক গদ সম্ভবত এই অস্থির পবিত্রতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন । তাই তার নাম দিয়েছিলেন স্যক্রম । অর্থাৎ পবিত্র অস্থি। আমরা যখন আত্ম সাক্ষাৎকার লাভ করি অর্থাৎ এই কুণ্ডলিনী যখন জাগ্রত হয়ে উপরিস্থিত ছয় টি শক্তি কেন্দ্র কে ভেদ করে ব্রম্ভচৈতন্যের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন আমরা এর ই ফলস্বরূপ আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে ব্রম্ভ চৈতন্য কে অনুভব করি । ঈশ্বরের সর্বব্যাপী প্রেম শক্তি বা চৈতন্য শক্তি শীতল স্পন্দন রূপে আমাদের হাতে এবং মাথায় অনুভূত হয় । প্রকৃত পক্ষে বিদ্যুৎ এর সঙ্গে সংযোগ না ঘটলে যেমন বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে না , তেমনি পরমাত্মা র সাথে আত্মার যোগ স্থাপন না হলে আত্ম সাক্ষাৎ কার সম্ভব নয় ।
বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থে কুণ্ডলিনী জাগরণ ও আত্ম সাক্ষাৎ কার বিষয়ে ঊল্লেখ রয়েছে । ১০৮ টী উপনিষদে এর বিস্তারিত বর্ণনা আছে । বাইবেলে একেই জীবন বৃক্ষ বলে অভিহিত করা হয়েছে । ইসলাম ধর্মে এই উত্তরণ “মে রা জ” বলে গুরুত্ব পেয়েছে । অর্থাৎ যে কোন ধর্মে ই এই উত্তরণের প্রয়োজনীয়তা নানা ভাবে প্রকাশ পেয়েছে । “ হোলি ঘোস্ট অব পেন্টে কষ্ট – এর শীতল বায়ু হল এই শক্তি যাহা সহজ যোগে অনুভব করা যায় । একে আদি শংকরাচার্য তার বিখ্যাত গ্রন্থ আনন্দ লহরী তে ‘সলিলম সলিলম’ বলে বর্ণনা করেছেন । সেন্ট টমাস তার দা গসপেল - এ খুব পরিষ্কার ভাবে এই ণব জণ্ম লাভ কেই জীবনের পরম প্রাপ্তি বলেছেন । ইসলাম ধর্মে এই নবজাগরণের সময় কে ‘কিয়ামত’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে । এ থেকেই বোঝা যায় যে জীবনের এই পরম প্রাপ্তি কেবলমাত্র আত্মসাক্ষাৎকার এর মাধ্যমেই সম্ভব ।
আধুনিক যুগের একই সঙ্গে বহু মানুষ ‘সহজ যোগে’ - এর মধ্য দিয়ে এই আত্ম সাক্ষাৎকার লাভ করছে । আত্ম সাক্ষাৎকার লাভ প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার, এটি কোন মানসিক প্রক্রিয়া নয়, কোন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একে লাভ করা যায় না । সহজ যোগের (সহ - কথার অর্থ সাথে এবং জ - অর্থাৎ জাত বা জন্ম যোগ - এর অর্থ হল ঈশ্বরের সর্বব্যাপী প্রেম শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন) মাধ্যমে সচেতনতার এক উচ্চ স্তরে একে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি এবং প্রমাণ করা যায়। কারণ এটা একটা জীবন্ত ক্রিয়া। ধরিত্রীমাতার বক্ষে বীজ বপন করা হলে তখন জলের সাহায্যে বীজ যেমন আপনা থেকেই বৃক্ষে পরিণত হয়, তেমনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে (spontaneously ) সহজ যােগের মাধ্যমে কুন্ডলিনী জাগরিত হয়। এই জাগরণ শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই সহজ ও স্বাভাবিক। অবশ্য শুদ্ধ ইচ্ছা ও সত্যানুসন্ধিৎসা থাকা চাই। | মাতৃগর্ভে ভ্রুন যখন ২-৩ মাসের হয় তখন ঈশ্বরের সর্বব্যাপী প্রেমের শক্তি থেকে উৎসারিত সচেতনতার রশ্মিরেখা ব্রহ্মতালু দিয়ে গর্ভস্থ সন্তানের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তাকে আলােকিত করে। মানুষের মস্তিষ্কের আকৃতি সমান্তরাল বহুভূজ পার্শ্বযুক্ত ঘন আকার বিশিষ্ট বস্তুর (প্রিজম prism এর ) মত হওয়ার দরুন সচেতনতার এই রশ্মিশুম্ভ তির্যক গতি প্রাপ্ত হয়ে চারটি পথে প্রবাহিত হয়। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের চারটি দিক এই শক্তিপথেরই বহিঃপ্রকাশ, যথা -
১। পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্র ( Parasympathetic Nervous System)
২। সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র - দক্ষিণ (Sympathetic Nervous System, right)
৩। সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র - বাম (Sympathetic Nervous System, left)
৪। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ( Central Nervous System )
এই শক্তির যে রশ্মিরেখা সমূহ মস্তিষ্কের তালু দিয়ে প্রবেশ করে, তারা সুষুম্না (মধ্যপথ) দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অবশিষ্ট শক্তি আমাদের মেরুদন্ডের সর্বনিম্ন অংশে ত্রিকোণাকার অস্থির মধ্যে সাড়ে তিন পাকে কুন্ডল পাকিয়ে অবস্থান করে। এই জীবন্ত শক্তিকেই “কুন্ডলিনী” বলা হয় এবং ত্রিকোণাকার অস্থিতে তার অবস্থানের জায়গাটি ‘মূলাধার” নামে অবিহিত ( চিত্র - ১)। কুন্ডলিনী শক্তির বিশেষত্ব হল তিনি ব্যক্তিকে এই জন্মেই নবজন্ম ( দ্বিজত্ব; resurrection) লাভ করবার, রােগমুক্ত করবার, নিজের ভারসাম্য বজায় রাখবার ক্ষমতা এবং আধ্যাত্মিক উত্থান দান করেন। উত্থান বা জীবনের ঊধগতির অর্থ হল আমাদের মন ও ক চারিদিকে রচিত মিথ্যার সীমানা পার হয়ে সামূহিক (collective) চেতনাকে লাভ করা। এই ‘মূলাধার” – এর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কুন্ডলিনী মাতার বৈশিষ্ট্য হল বিশুদ্ধ কৌমার্য, পবিত্র মাতৃস্নেহ এবং পবিত্রতা । এই সূক্ষ্ম শক্তি মস্তিষ্কের মধ্যভাগ (ব্রহ্মরন্ধ্র) দিয়ে প্রবেশের পর পথে আরও ছয়টি শক্তিকেন্দ্র (চক্র) স্থাপন করে যার স্থূল বহিঃপ্রকাশ ঘটে স্নায়ুজালক (plexus) রূপে। এই চক্রগুলি মেরুরজ্জ (spinal cord) - তে অবস্থিত ; মেরুদন্ডের ( vertebral column - এর) বাইরে স্নায়ুজালকগুলি । তারই প্রকাশ। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, একটি প্রধান স্নায়ুজালকের ছােট। জালক বা সহজালক (subplexus) - এর সংখ্যা এবং তার প্রতিনিধিত্বকারী । চক্রের পাপড়ির ( petals) সংখ্যা অনুরূপ। শক্তিপথ -ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ী
(চিত্র- ১) ও (চিত্র- ২) - ভূণ অবস্থায় যে রশ্মিরেখা সমূহ মস্তিষ্কের মধ্যভাগ (তালু) দিয়ে প্রবেশ করে তার তির্যক গতি প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এই শক্তি যে মধ্যপথে প্রবাহিত হয় তাকে সুষুম্না নাড়ী বলে --- বাহ্যিকভাবে এর প্রকাশ ঘটে পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্ররূপে। এই নাড়ী আমাদের বর্তমানে রাখে, আমাদের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। আত্মসাক্ষাৎকার লাভের সময় কুন্ডলিনী জাগ্রত হয়ে এই পথ দিয়ে ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হয় ও সহস্রার ভেদ করে। তখনই আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটে। সেই সময় আমরা মাথার উপর এবং দুই হাতে শীতল বায়ু ( cool breeze) অনুভব করি।।
যে সমস্ত রশ্মিসমূহ প্রিজম্রূপ মস্তিষ্কের পার্শ্বদেশে পড়ে তির্যক গতি প্রাপ্ত হয় তারা বাম ও দক্ষিণ পথ ( যথাক্রমে ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী) দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই দুই নাড়ীর বাহ্যিক প্রতিফলন ঘটে বাম ও দক্ষিণ সমবেদী স্নায়ুতন্ত্রে।
বাম পথের (ইড়া নাড়ীর) অপর নাম চন্দ্রনাড়ী। এটি মূলাধার চক্রে শুরু হয়ে বাম দিক দিয়ে উঠে আজ্ঞাচক্রের মধ্য দিয়ে অপর দিকে চলে আসে এবং মস্তিষ্কের দক্ষিণ দিকে প্রতিঅহঙ্কার (super-ego) বা সংস্কার (conditionings) - এর সৃষ্টি করে। এই নাড়ীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের। ইচ্ছাশক্তিকে পরিচালনা করা, যে ইচ্ছাশক্তির ফলে আমরা সমস্ত কাজ করার উৎসাহ লাভ করি। যতদিন পর্যন্ত এই নাড়ীটি ২ যশীল ও সক্রিয় থাকে ততদিন মানুষের জীবনধারণের বাসনা থাকে। চন্দ্রনাড়ীর কাজের ফলে আমাদের মনে অতীতের স্মৃতি জেগে ওঠে এবং এই নাড়ী আমাদের আবেগ অনুভূতিকে সঞ্চালিত করে। ইড়া নাড়ী স্ত্রীগুণ সমূহকে প্রকাশ করে, যেমন – অনুভূতি-প্রবণতা, সহযােগিতা, নম্রতা ইত্যাদি।
পিঙ্গলা নাড়ীর অপর নাম সূর্য নাড়ী। এটি স্বাধিষ্ঠান চক্র থেকে ডান দিক দিয়ে উঠে এসে আজ্ঞা চক্রের মধ্য দিয়ে অপর দিকে চলে যায় এবং মস্তিষ্কের বাম দিকে এই নাড়ী ব্যক্তির ক্রিয়াকর্মের ফলস্বরূপ অহং (ego) ভাবের সৃষ্টি করে। সূর্য নাড়ী ডান সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের দৈহিক কর্ম ও বুদ্ধিকে সঞ্চালিত করা। ইচ্ছাকে কর্মে পরিণত করার জন্য ক্রিয়ার নির্দেশ এই নাড়ী থেকেই আসে। আমরা ভবিষ্যত সম্পর্কে যা কিছু চিন্তা করি তা ডানদিকে গ্রথিত হয়ে থাকে। সূর্যনাড়ী পুরুষােচিত গুণসমূহ যেমন - বিশ্লেষণ শক্তি, আক্রমণাত্মক ও প্রতিযােগিতামূলক মনােভাব ইত্যাদির প্রকাশক। | আত্মসাক্ষাৎকার লাভের পর যখন ইড়া’ ও ‘পিঙ্গলা’ নাড়ী (যা যথাক্রমে অতীত ও ভবিষ্যতের প্রকাশক) সমতায় আসে, তখন সাধক বর্মানেই স্থিত হয়ে যায় (সুষুম্না নাড়ীর কাজ)। সাধক উপলব্ধি করে যে অতীত শেষ হয়ে গেছে, ভবিষ্যতের কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু বর্তমানই সত্য ও প্রকৃত আনন্দের উৎস।
স্বশাসিত বা স্বয়ংক্রিয় নাৰ্ভতন্ত্র
( Autonomic Nervous System ) | বাম ও ডান সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র এবং পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্রকে একত্রে স্বয়ংক্রিয় বা স্বশাসিত স্নায়ুতন্ত্র বলা হয়। এর অর্থ হল, যে তন্ত্র (system) স্বয়ং চালিত (নিজেই নিজেকে চালনা করে)। কিন্তু প্রশ্ন হল যে এই স্বয়ং কে, যে আমাদের এই স্বশাসিত নাৰ্ভতন্ত্রের চালক ? ডাক্তারগণ একে স্বয়ংচালিত প্রক্রিয়া বলে থাকেন, কিন্তু স্বয়ং বা আত্ম কে? | এই স্বয়ং হলেন আত্মা। ইনি প্রতিটি মানব হৃদয়ে বাস করেন এবং সাক্ষীস্বরূপে বিরাজ করেন। আত্মা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি, আর কুন্ডলিনী হলেন ঈশ্বরের শক্তির বা পরমাত্মার ইচ্ছাশক্তির (আদিমাতার) প্রতিফলন। সর্বব্যাপী প্রেমশক্তি আমাদের আদিমাতারই শক্তি; যিনি সবকিছু সৃষ্টি ও বিবর্তন করেন এবং সমস্ত জীবন্ত ক্রিয়াই সম্পাদন করেন। । প্রকৃতপক্ষে আমাদের শারীরিক ব্যবস্থায় তিনটি স্নায়ুপথ বা নাড়ী আছে। মধ্যপথ হল সুষুম্না, যেটি পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্রের পরিচর্যা করে। বাঁদিকে স্থিত নাড়ী (ইড়া), বাম সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রকে চালনা করে ও ডানপাশে স্থিত নাড়ী (পিঙ্গলা) ডান সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রকে চালায়।
স্বয়ংক্রিয় নাৰ্ভতন্ত্রের একটি উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে আমরা যদি হৃদযন্ত্রের গতিকে বাড়াতে চাই, সেটা আমরা করতে পারি আমাদের হৃদযন্ত্রকে অতিমাত্রায় প্রয়ােগের মাধ্যমে (সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের ক্রিয়া) ; কিন্তু যদি আমরা তাকে কমাতে চাই তাহলে তা পারি না (পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের ক্রিয়া)। পরাসমবেদী স্নায়তন্ত্র যেন এক পেট্রল পাম্পের মত যা থেকে ঈশ্বরের প্রেমশক্তিরূপ পেট্রল অনর্গল প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
শিশু জন্মগ্রহণের সাথে সাথে তার নাভির নাড়ী যখন ছেদন করা হয় তখনই সুষুম্না নাড়ীর ভিতর একটি ফাঁকের সৃষ্টি হয় – এর প্রতিফলন পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রেও দেখা যায়। এই শূন্য স্থানটিকে “জেন তত্ত্বে” (Zen system এ) শূন্যগর্ভ (void) বলে, ভারতীয় শাস্ত্রে “ভবসাগর” বা “মায়া” বলে এটি অবিহিত। ডান ও বাম সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের কার্যকলাপের দরুন এই দুই তন্ত্রের 'চূড়ায়, মস্তিষ্কের দুপাশে যথাক্রমে অহঙ্কার ও প্রতিঅহঙ্কার (সংস্কার)-রূপ দুটি বেলুনের সৃষ্টি হয়। এই বেলুন স্ফীত হয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রকে যখন ঢেকে ফেলে তখন আত্মার সঙ্গে সর্বব্যাপী প্রেমশক্তির সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ নিজেকে স্বতন্ত্র একটি সত্ত্বা বলে ভাবতে থাকে এবং আমিত্ব’-এর ধারণা তার উপর কর্তৃত্ত্ব করে। | হঠযােগ কথাটি “হ” এবং “ঠ’ থেকে আসে, এর অর্থ “সূর্য” এবং “চন্দ্র”। সূর্য (পিঙ্গলা) নাড়ী এবং চন্দ্র (ইড়া) নাড়ীর ব্যবহারই এই যােগের বৈশিষ্ট্য। হঠযােগ সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের কার্যকলাপকে পরিচালনা করে, তাই তার বহিঃপ্রকাশও এই যােগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন হৃদযন্ত্রের গতি স্বল্পসময়ের জন্য কমান বা বন্ধ করা যায়। কিন্তু উভয় সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের চূড়ায় মস্তিষ্কের দুপাশে “অহংকার” ও “প্রতিঅহংকার”- এর বেলুন এই দুই পথেরই পরিসমাপ্তি ঘটায় অর্থাৎ ঈশ্বরের সর্বব্যাপী প্রেমশক্তির সাথে যুক্ত হওয়ায় কোন দ্বার এখানে বিরাজ করে না। এই প্রক্রিয়া পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রকে কখনই কার্যান্বিত করে না, অথচ এই স্নায়ুতন্ত্রের পথই ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রকৃত পথ।
সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্র ও পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্র উভয়ই স্নায়ুজালকের উপর কাজ। করে কিন্তু বিপরীত ভাবে। পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্র এই জালকগুলিকে তথা চক্রগুলিকে শিথিল (relax) করে, কিন্তু সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র এদের সঙ্কুচিত (constrict) করে তার থেকে সীমিত শক্তি ব্যবহার করে এবং চক্রগুলি থেকে জীবনীশক্তি ব্যয় হতে থাকে। সুযুরা তথা পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রে একটি শূন্যস্থান (gap) আছে, কিন্তু সমবেদী তরে এইরূপ নাভির চারপাশে কোন ফাঁক নেই। এতকাল এটাই ছিল প্রতিটি সন্ধিৎসু সাধকের সুষুম্নায় প্রবেশে ফলপ্রসূ হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা যেন তিনটি সিড়ির মধ্যে মধ্যবর্তী সিঁড়ি ভূমিস্পর্শ না করে হাওয়ায় ঝুলছে। তাই আমরা যখনই আমাদের সচেতনতায় ঊর্ধে উঠতে চেয়েছি তখনই পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্র থেকে সরে গিয়ে বাম অথবা দক্ষিণ সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রকে ব্যবহার করেছি।
এইভাবে ডান দিকে চলে গিয়ে আমাদের অহংকারে স্ফীত বেলুনকে ক্রমশ প্রশ্রয় দিয়েছি, যা থেকে মনে এমন ভাবের সঞ্চার হয়েছে যে আমাদের দ্বারাই সব কাজ সাধিত হচ্ছে। এইরূপ ভাব যখন সীমা অতিক্রম করে তখন সে একটি অপরিণত শিকড় বিশিষ্ট বৃহৎ বৃক্ষের মত হয়ে ওঠে এবং অচিরেই ভূতলে পতিত হয় ।
বাম সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র সৃষ্টির সময় থেকে যা কিছু মৃত তা আমাদের অবচেতন মনে সঞ্চিত রাখে। এরও গভীরে একটি সামূহিক অবচেতনা (ভূতলােক বা পরলােক) আছে। বিবর্তন কালের চক্রে যা কিছু অবলুপ্ত ( যেমন- গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ) তা এই সামূহিক অবচেতন মনে সঞ্চিত থাকে। তান্ত্রিক ও অন্যান্য ভন্ডগুরু, তাদের জাদুবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, সম্মােহন শক্তি ইত্যাদি দ্বারা সত্যসন্ধানী মানুষকে এমনভাবে পরিচালনা করে যাতে সাধক বাম দিকের নাড়ী | অত্যধিক ব্যবহার করে ধ্যান বা মনসংযােগ ঘটায়। দেখা যায় সাধকঅনেক সময় প্রথমে দেহও মনে শিথিলভাব অনুভব করে এবং চিন্তাভাবনা থেকে অব্যাহতি পায়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সে তার দুর্বলতাকে বুঝতে পারে; বাস্তবের সম্মুখীন হতে সে ভীত হয় এবং সকলের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে । এইরূপ জীবন যাপনে মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত যেমন রয়েছে, (১তমন মানসিক রােগের শিকার হওয়া, এমনকি কালক্রমে উন্মাদে পরিণত হওয়ার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। কয়েক ক্ষেত্রে এই সমস্ত তথাকথিত গুরুরা সম্মােহন শক্তি দিয়ে সাধকের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব করতে থাকে এবং একপ্রকার দাসে পরিণত করে তার সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করে। সাধক নিজেও তার এই সমর্পণের কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। এইভাবে অসৎ গুরুরা সত্যসন্ধানী মানুষদের পথভ্রষ্ট করে দেয়। প্রকৃত পক্ষে ধর্মের নামে এই সকল ক্রিয়াকলাপ বা কুন্ডনিলী শক্তির অপব্যবহার সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রকেই (ইড়া বা পিঙ্গলা নাড়ীকেই) কার্যান্বিত করে, পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্রকে (সুষুম্না নাড়ীকে) কোনভাবে জাগ্রত করতে পারে না।
সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের অতিরিক্ত ব্যবহার, তা-সে যেভাবেই হােক, পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের সঙ্গে তার স্বাভাবিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। ফলে মানুষ নানাবিধ ব্যাধির শিকার হয়, যেমন মানসিক রােগ, ক্যানসার, মধুমেহ (ডায়াবেটিস্ মেলাইটাস), অনিদ্রা, অম্লরােগ, উচ্চ রক্ত চাপ (হাই ব্লাডপ্রেসার) প্রভৃতি। আত্মসাক্ষাৎকার লাভের পর যখন পরাসমবেদী নাৰ্ভতন্ত্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, তখন সমবেদী নাৰ্ভতন্ত্রের ভারসাম্যহীন অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ সমতায় আসে, সঙ্কুচিত চক্র - তথা স্নায়ু জালকদিগকে শিথিল করে এবং সাধককে ব্যাধিমুক্ত হতে সাহায্য করে।
চক্র (শক্তিকেন্দ্র)
(১) মূলাধার চক্র -
প্রথম চক্রটি যা মূলাধার চক্র নামে কথিত, তা আমাদের দেহের একোণাকার অস্থির নীচে মেরুদন্ডের সামান্য বাইরে অবস্থিত। এই চক্র বিকশিত লে। পবিত্রতা, সরলতা, ভক্তি ও জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। এই চক্রের যিনি অধিষ্ঠাতা (দলতা, তিনি কুন্ডলিনী মাতার পবিত্রতা রক্ষার জন্য নিরন্তর প্রহরায় নিযুক্ত। কুণ্ডলিনী মাতার বাসস্থান যাকে “মূলাধার” বলা হয় তা এই চক্রের উপরে ত্রিকোণাকার অস্থিতে অবস্থিত। তাঁর এই অবস্থান আমাদের এটাও মনে করিয়ে (দয়া যে আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রে যৌনতার কিছুমাত্র স্থান নেই। এই চক্র দুর্বল হলে অথবা অপবিত্রতার কালিমালিপ্ত হলে কুন্ডলিনী নিজ স্থান ত্যাগ করে ঊতি লাভ করেন না। যদিও কুন্ডলিনীকে উপরি-হিত ছয়টি চক্র পার হয়ে উথিত হতে হয়, প্রথম চক্র (মূলাধার চক্র) কুন্ডলিনী মাতার জাগরনের সময় তাঁর পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করে। কুন্ডলিনী ‘মূলাধার থেকে উত্থিত হয়ে সপ্তম চক্রে মিলিত হলে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যােগ স্থাপিত হয় এবং সামূহিক সচেতনতার (collective consciousness) অবস্থা প্রাপ্ত হয়।
মূলাধার চক্রের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে শ্রোণীজালক (pelvic plexus) - রূপে। এই চক্র শরীরের দুটি কার্য সম্পাদন করে – আমাদের দেহের অভ্যন্তর থেকে মালা বহিষ্কার করে এবং যা রক্ষণীয় তা রক্ষা করে। এই চক্র যৌনসংক্রান্ত ও জন্মসংক্রান্ত নানাবিধ কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। ডাইরিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য -- এই দুই-ই মূলাধার চক্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে। নানাপ্রকার | জাদু ও ভূতবিদ্যা অভ্যাস এবং ড্রাগ সেবন এই চক্রের বিশেষ ক্ষতি করে। মুলাধার চক্রের জাগরণ ঘটলে প্রজ্ঞা লাভ হয়; নিজেকে সৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গ *, চরিত্রের নির্মলতা রক্ষা করা এবং স্থির লক্ষ্যে যাবার শিক্ষা লাভ হয়ে থাকে। এই রূপ গুণ বিশিষ্ট ব্যক্তি শুভলক্ষণযুক্ত হয় এবং নিজের চারপাশে পরম আনন্দের আবহাওয়া বিস্তার করে।
(২) সাধিষ্ঠান চক্র -
আমাদের দেহে দ্বিতীয় চক্রটি নাভির নীচে অবস্থিত ও স্বাধিষ্ঠান চক্র নামে অবিহিত। সকল ক্রিয়াশক্তি এই চক্রের সাহায্যে কার্যান্বিত হয়। স্বাধিষ্টান চক্র এয়রটিক্প্লেক্সাসের (aortic plexus ) সমস্ত কাজ দেখাশােনা করে এবং মূত্রগ্রন্থি (kidney), যকৃতের নিম্নাংশ, ক্লোম (pancreas), অন্ত্র (intestines) ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই চক্র উদরের চর্বিকে ভেঙে মস্তিষ্কের পুষ্টি সাধন করে। এরফলে চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে যা আমাদের কলাশক্তি ও চারুকলা প্রকাশে উৎসাহ দান করে। তাই অত্যধিক চিন্তাতে সূর্যনাড়ী পরিশ্রান্ত হলে স্বাধিষ্ঠান চক্রকে দুর্বল করে দেয়। মনঃসংযােগ কেবলমাত্র মস্তিষ্কে নয়, প্রকৃতপক্ষে তা যকৃতেঅবস্থান করে। সেই জন্য মাদকদ্রব্য সেবন যা যকৃতের বিশেষ ক্ষতিসাধন করে, তা মানুষের সুন্দর চিন্তা শক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে ও মনঃসংযােগে বাধা দেয়। স্বাধিষ্ঠানের বামদিকের গুণগত বৈশিষ্ট্য হল শুদ্ধ বিদ্যা। তথাকথিত দৈবজ ও প্রেত বিদ্যা এই চক্রের পবিত্রতা ও নির্মলতা নষ্ট করে, কারণ শুদ্ধবিদ্যা এই চক্রের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। কৃত্রিমতা, অমার্জিত আচরণ। স্বাধিষ্ঠানের প্রকৃত অনুভূতিশীলতার পক্ষে ক্ষতিকারক।
(৩) মণিপুর বা নাভিচক্র :
দেহের এই তৃতীয় চক্রটি নাভির পিছনে অবস্থিত। এই চক্র শারীরিক স্তরে পাকস্থলীর জালক (solar/coeliac plexus) -এর কাজকর্ম তদারক করে এবং পাকস্থলী ও যকৃতের উপরিভাগের ক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টি রাখে। তাই পাকস্থলীর কাজে বিঘ্ন ঘটনে খাদ্য পরিপাক করার ক্ষমতা কমে যায় এবং নাভিচক্রের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। খাদ্যবস্তুতে অত্যধিক লােভ ও মনােযােগ দিলেও এতে প্রতিকুল প্রভাব পড়ে। | মানুষের জীবনে পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকবার জন্য যে ধর্ম অত্যন্ত জরুরী, সেই ধর্ম এই নাভিচক্রেই অবস্থান করে। এই ধর্ম আমাদের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে সর্বজনস্বীকৃত ন্যায়-অন্যায় বােধের উদ্রেক করে। শ্রীমাতাজী বলেছেন, “কার্বনের যেমন চারটি যােজ্যতা আছে, যে কোন অবস্থাতেই সােনার যেমন অপরিবর্তিত থাকবার ক্ষমতা আছে; সেইরকম মানবজীবনের প্রকৃত শ্রেষ্ঠ বস্তু ও প্রধান অবলম্বন হল ধর্ম। মানুষ অ্যামিবা থেকে বিবর্তনের ফলে আজ এই স্তরে উন্নীত হয়েছে তার সেই ধর্মের মধ্যে দিয়ে। এটাই বিবর্তনের নিয়ম -বিধি। জীবনের এই মূল নিয়মই আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিকে পুষ্টি যােগায় এবং রক্ষা করে।” সেইকারণে আমরা বাইবেলে মােজেজ বর্ণিত দশটি অবশ্য পালনীয় বিধান (Ten Commandments) লাভ করেছি। নাভিচক্র আমাদের যাবতীয় হিত ও মঙ্গলসাধনের কেন্দ্র ও উৎস। মানুষের সাংসারিক উন্নতি যত বেড়েছে, তার জন্য সন্তষ্টি না এসে অর্থলােভ ও লালসা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে মনকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করেছে। এর ফলে নাভিচক্রের উপর চাপ ও বাধা উৎপন্ন হয়। দক্ষিণ নাভিচক্রের গুণগত কার্যের ফলস্বরূপ ব্যক্তি তার নিজ বস্তুগত উন্নতিলাভের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়, যথা-ব্যবসা, অর্থন্নতি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, যুক্তিপূর্ণ চিন্তাকরা ইত্যাদি। কিন্তু বিশৃঙ্খল জীবনযাপন, অথোপার্জনে অপটুতা, যুক্তিপূর্ণ চিন্তার অভাব – এইসব অবস্থায় লুঝতে হবে যে দক্ষিণ নাভি চক্রে বাধা রয়েছে।
উত্তেজিত ও অস্থির জীবনযাপন প্লীহাতে চাপ সৃষ্টি করে ও নাভিচক্রের মভাগকে দুর্বল করে দেয়। স্ত্রীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ, সাংসারিক দুশ্চিন্তা, মাহপ্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে সমস্যা এবং সর্বদা অন্তরে ভয়ের সঞ্চার – এইসব কারণ নাভিচক্রের বামভাগকে বিক্ষুব্ধ করে। দুর্বল বাম নাভিচ হলে অ্যালার্জির প্রকোপ বাড়ে, নানান জীবাণু যথা –– ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক (fungus), পরভুক জীবাণু (parasite) ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। | ধমচিরণ, ভদ্র ব্যবহার, কল্যাণ ও সহিষ্ণুতা ইত্যাদি এই চক্রের গুণ। কৃপণতা, মাদকদ্রব্য সেবন, বাধাযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ প্রভৃতি এই চক্রের পক্ষে ক্ষতিকারক; ভগবানের নামে উপবাস করলেও এর হানি ঘটে।
(৩, ক) ভবসাগর -
স্বাধিষ্ঠান ও নাভিচক্রকে বেষ্টন করে যে শূন্যগর্ভটি আমাদের দেহে অবস্থান করে, তাকে আমরা “ভবসাগর” বলি। এইটি উপরি-উক্ত চক্র দুটিকেই প্রভাবিত করে থাকে। ভন্ডগুরু, অসৎ ব্যবহার ও ধর্মান্ধতা এই স্থানে বাধা উৎপন্ন করে। ব্যক্তির জীবনযাপনের পদ্ধতি, তার ব্যক্তিত্ব, স্বভাব, ব্যবহার ও কর্মধারা (অথাৎ ধর্ম), গ্রহের প্রভাব ইত্যাদি ভবসাগরে প্রকাশিত হয়। আত্মসাখাৎকারের পূর্বে সত্য থেকে আমাদের সচেতনতার স্তরকে এই শূন্যগর্ভ বিভক্ত করে রাখে। কিন্তু আত্মসাক্ষাৎকার লাভের পর যখন কুন্ডলিনী এই শূন্যগর্ভ কে পূর্ণ করে তখন আমাদের চিত্ত মায়ার সাগর অতিক্রম করে, মােহমুক্ত হয়ে সত্যের সচেতনতা লাভ করে। গুরুতত্ত্ব এই স্থানেই প্রতিফলিত হয়। যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা আদিগুরু রূপে। মানবাত্মার উত্থান লাভের জন্য বার বার মহাগুরু হয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, যেমন - সক্রেটিস্, মােজেজ, মহম্মদ, গুরুনানক, রাজা জনক, সির্দী সাঁইনাথ প্রভৃতি। তাঁরা সর্বতােভাবে সমস্ত চরমপন্থা পরিত্যাগ করে দৈনন্দিন জীবনে ভারসাম্য (balance) আনবার পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কুন্ডলিনী উর্ধগতি লাভ করবার পর ভবসাগরে প্রবেশ করলে ব্যক্তি জ্ঞানের আলােকে আলােকিত হয়ে থাকে এবং নিজেই নিজের গুরুতে পরিণত হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ আজকাল চারিদিকে ভন্ডগুরুগণ তাদের ভক্তের নিকট উদ্ধার কর্তার মুখােশ লাগিয়ে তাকে সম্পূর্ণ বশ করে তার জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে।
(৪) অনাহত (হৃদয়) চক্র
অবতারগণ ও দিব্য জ্ঞানপ্রাপ্ত গুরুদিগের বৈশিষ্ট্যই হল প্রেম ও সহানুভূতিশীলতা। নির্মল ও সুস্থ হৃদয় চক্র থেকেই উৎসারিত হয় এই অপরিসীম করুণা। যদি পতিপত্নী একে অপরের উপর কর্তৃত্ত্ব করে তবে তাদের স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। স্বামীর অত্যধিক প্রভাব স্ত্রীর মর্যাদা বােধকে ক্ষুন্ন করে এবং একধরনের চাপা ক্রোধ জন্মে। এই ক্রোধ তার সন্তানের প্রতি রূঢ় ব্যবহার ও আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে বিভিন্ন স্তন সংক্রান্ত পীড়াও দেখা দিতে পারে।
নির্মল পবিত্র প্রেমের দেবতা এই চক্রে অধিষ্ঠান করেন। পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের সুসম্পর্ক এই হৃদয়চক্রেই প্রকাশিত হয়। শুভ ও প্রেমপূর্ণ হৃদয়ে দৈনন্দিন জীবন যাপন, স্বামী - স্ত্রীর সুসম্পর্ক ও সু- আচরণ এবং যে প্রয়ােজনীয় সামাজিক মূল্যবােধ মানবজাতিকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উন্নতির পথে নিয়ে যায় তারই প্রকাশ ঘটে এই হৃদয় চক্রে। বক্ষাস্থি (sternum) - এর পিছনে অবস্থিত এই চক্র আমাদের দেয় নিরাপত্তাবােধ ও সুরক্ষা। উক্ত এই আচরণ বিধির সঠিক অনুসরণই আমাদের আত্মােপলব্ধির সহায়ক। এই নির্দেশাবলী হৃদয়চক্রের আচরণবিধি (protocol) - কে রক্ষা করে।
বাম হৃদয়চক্রেই “আত্মা” বিরাজ করেন। আমরা জানি যে শারীরিক দিক দিয়ে হৃদ্যন্ত্র হল দেহের পা (pump) স্বরূপ, যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে করে। তাই মানসিক বা দৈহিক অত্যাচার হার্টের পক্ষে ক্ষতিকর। অত্যাধিক শরীরচর্চা, মল্ল ক্রীড়া , হঠ যােগের অনুশীলন ইত্যাদি হার্টকে করে পরিশ্রান্ত, ফলে অনেক সময় হৃদ্যন্ত্রের অসুখ দেখা দেয়।
(৫) বিশুদ্ধি চক্র
বিশুদ্ধি চক্র আমাদের দেহে ছাঁকনি (filter) রূপে কাজ করে। এই সূক্ষ্ম যন্ত্রটি বাইরের সকল দুষিত পদার্থ (যেমন জীবাণু প্রভৃতি) দেহে প্রবেশ করার থেকে রক্ষা করে । কলকারখানা বা ধূমপান থেকে আগত ধোঁয়ায় শ্বাসগ্রহণ করলে এই চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্বিবাদে সর্বপ্রকার মন্ত্রোচ্চারণ অথবা অসৎ গুরু প্রদত্ত মন্ত্র গ্রহণ বিশুদ্ধ চক্রের সংবেদনশীলতা বিনষ্ট করে এবং বাধার সৃষ্টি করে। কণ্ঠদেশে অবস্থিত এই চক্রের স্থুল বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঘাড় সম্বন্ধীয় জালক (Cervical plexus) রূপে। এই চক্র আমাদের কান, নাক ঘাড়, গলা, জিহ্বা,দাঁত ইত্যাদিকে দেখাশোনা করে। |
অপরাধ জনিত কর্মের ফলে যে অপরাধবােধ জন্মে তা থেকে এই চক্রের বাম দিকে বাধা আসে। অপরাধবােধ হল একপ্রকার অহমিকার প্রকাশ যা পরিপূর্ণ হয় নি। “দোষ’ শব্দটিই কাল্পনিক, কারণ আমাদের যখন আত্মােপলব্ধি ঘটে অথাৎ আত্মার স্বরূপ বুঝতে পারি তখন এই অপরাধ পীড়িত মানসিকতা আপনা (থকেই লুপ্ত হয়।
এই চক্রের অধিষ্ঠাতা দেবতা কুশলী পরিচালক হওয়াতে, মানুষ চতুর ও নীতিযুক্ত কৌশলের সাহায্যে নিজ বিপদ আপদ কাটিয়ে উঠতে পারে। বিশুদ্ধি চক্র পূর্ণ বিকশিত হলে মানুষ তখন তার ক্ষুদ্রতা বােধের ঊর্ধে উঠে নিজেকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের অংশরূপে জ্ঞান করতে পারে। কূটনৈতিক কর্মকুশলতা, মধুর অভিব্যক্তি, সাক্ষীভাব, সামূহিকতা প্রভৃতি এই চক্রের বিশেষ গুণ।
(৬) আজ্ঞা চক্র
মস্তিষ্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, আজ্ঞা চক্রকে কখনও কখনও তৃতীয় নয়ন বলে অবিহিত করা হয়েছে। ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ী এই চক্রের ভিতর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে অপরদিকে চলে এসেছে এবং যথাক্রমে মস্তিষ্কের ডান দিকে “প্রতিঅহঙ্কার’ (বা “সংস্কার’) এবং বাম দিকে “অহঙ্কার” - এর বেলুন সৃষ্টি করেছে । কুণ্ডলিনী যখন উত্থিত হয়ে হয়ে এই চক্র অতিক্রম করে তখন সাধকের চিন্তার স্রোতে বিলম্বের সৃষ্টি হয় । অর্থাৎ দুটি চিন্তার মাঝে ফাঁক থাকে তা বিস্তৃত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সাধক চিন্তাহীন নৈঃশব্দের জগতে প্রবেশ করে ।
এই সূক্ষ্ম চক্রটির বিশেষ গুণ হলো ক্ষমাশীলতা । কিন্তু অহংকারী মানুষ অপরকে ক্ষমা করতে পারে না । ফলে তাদের আজ্ঞা চক্র দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় এবং ঈশ্বরের দরবারে পদার্পণের পথ বন্ধ হয়ে যায় । মানব জীবনের উন্নতির কর্ম বিকাশের ষষ্ঠ ধাপে, আজ্ঞা চক্র শ্রী যীশু খ্রীষ্ট মানব জাতিকে মুক্তি দান করার জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাদের শিখিয়েছেন কিভাবে করতে হয় ।ক্ষমার যে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে্ নিজে অপরাধীদের ক্ষমা করে এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার কষ্ট স্বীকার করে -তা থেকে মানুষের মনে নম্রতার ভাব সঞ্চরিত হয় । মানুষ বুঝতে শেখে কি করে অহংকার বিসর্জন দিয়ে বিনম্র ক্ষমাশীল হয়ে ওঠা যায় এবং নির্বিচারিতার এক উচ্চস্তরে আরোহন করা যায় । এভাবে আত্ম সাক্ষাৎকার লাভের পর কূণ্ডলীনি যখন আজ্ঞা চক্রকে প্রস্ফুটিত করে, তখন ক্রমশঃ অহংকার ও প্রতিকারের বেলুন যে আজ্ঞা চক্র কে আবৃত করে রেখেছিল তার উন্মোচন ঘটে এবং কুণ্ডলিনী অতি সহজেই সহস্রারে পৌঁছে যায় ।
ইতস্তত অস্থির দৃষ্টি ষষ্ঠ চক্রের একাগ্রতায় আলোড়ন তোলে । অতিমাত্রায় টেলিভিশন দেখা বা চলচ্চিত্র পর্যবেক্ষণ করা , ঈশ্বর সম্বন্ধে ভুল ধারণা এই চোখের পক্ষে হানিকারক । তথাকথিত ধর্ম প্রধানরা অনেক সময়ই খুব গোঁড়া হয়, তারা ধর্মশাস্ত্রে বচ্ন কে যতখানি গুরুত্ব দেয় অবতার গণের নির্দেশাবলীর মূল তত্ত্ব ততখানি অনুধাবন করে না । সেই কারণে তাদের এবং অন্য ভন্ড গুরুদের কাছে মস্তক অবনত করা হলে একইভাবে এই চক্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
(৭) সহস্রার (শীর্ষস্থ চক্র)
আমাদের দেহের সূক্ষ্ম যন্ত্রটিতে যেসকল চক্র রয়েছে সহস্রারে এসে তারা সবাই একত্রিত হয়ে যায় । এখানে প্রত্যেকটি চক্রেরই নির্দিষ্ট স্থান আছে ।
কুণ্ডলিনী যখন এই সপ্তম চক্র টিকে উন্মোচিত করে তখন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সামূহিক সচেতনতা অনুভূত হয় । এ কোন ধারণা বা অনুমান নয়, এটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তব। সাধক অনুভব করে যে কুণ্ডলিনী ঊর্ধ্বগতি লাভ করে শীর্ষ চক্র অতিক্রম করেছে এবং অন্তঃস্থিত উত্তাপ ও উত্তেজনা ক্রমশ মুক্তিলাভ করছে। মাথার উপর তখন সে শীতল স্পন্দন উপভোগ করে। এইভাবে তার দিজত্ব প্রাপ্তি ঘটে । এই আলোকপ্রাপ্ত সচেতনতা তখন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অনুভূত হয় , যার প্রকাশ স্বরূপ সাধক আঙুলের ডগায় চক্র গুলোকে অনুভব করে । এই সংকেত সাধককে বলে দেয় , তার কোন চক্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে সে এই চক্র গুলিকে প্রয়োজনমতো সংশোধন করতে পারে এবং শরীরের অসুস্থ অঙ্গগুলোকে সুস্থ করে তুলতে পারে। সেই সাধক তখন শুধুমাত্র নিজের কুন্ডলীর অবস্থান অনুভব করেনা সামরিক সচেতনতায় সে অন্য কোনো ব্যক্তির দিকে চিত্ত নিক্ষেপ করলে তার সূক্ষ্ম যন্ত্রটির কার্যকলাপ ও উপলব্ধি করে। এই আলোকপ্রাপ্তি তাকে যে শান্তি ও আনন্দের রাজ্যে নিয়ে যায় তার ফলে তার মধ্যে এক সুন্দর ভারসাম্যের সৃষ্টি হয়। এই স্তরে পৌঁছে গেলে সাধক সকল কাজের মধ্যেই এই আলোকিত সচেতনতাকে অনুভব করতে থাকে।
কুণ্ডলিনী জাগরণের ফলে মানুষের চিত্ত অতীত ও ভবিষ্যতের নাগপাশ ছিন্ন করে বর্তমানে বিরাজ করতে শুরু করে। নদী যেমন সব বাধা অতিক্রম করে সাগরের দিকে এগিয়ে চলে ঠিক তেমনই কুণ্ডলিনী তার উত্তরণের পথে সমস্ত বাধা কে পরিস্কার করে অগ্রসর হয় এবং সহস্রারে মিলিত হয়। এই মিলন আপনার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন , ক্ষুদ্রের সঙ্গে বিরাটের। এই মিলন হল মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য, তার পরম প্রাপ্তি।
ধ্যান (meditation)
পরম পূজ্যা মাতাজী নির্মালা দেবী প্রবর্তিত সহজযোগ বিশ্বের এক অমূল্য সম্পদ । এই ধ্যান পদ্ধতি অতি সহজ সরল ও সতস্ফুর্ত । প্রথমবার আত্ম সাক্ষাৎকার লাভের পর কুণ্ডলিনী কে উত্তরণের পথে পরিচালনার জন্য প্রত্যহ গৃহে ধ্যান করা কর্তব্য ।
আপন গৃহে ধ্যান:-
সহজ যোগ ধ্যান কেন্দ্র থেকে শ্রী মাতাজী র একটি আলোকচিত্র (photograph)সংগ্রহ করুন। কাঠের ফ্রেমে ছবিটি বাঁধিয়ে নেবেন । তবে দেখবেন ফ্রেমেটি যেন কালো রঙের না হয়। একটি পরিষ্কার উঁচু জায়গায় ছবিটিকে রাখুন এবং ঘড়ি চশমা খুলে পরিধেয় বস্ত্রাদি শিথিল করে ছবির সামনে দুই হাত প্রসারিত অবস্থায় বসুন । ছবির সামনে প্রদীপ বা মোমবাতি এবং ধূপ জ্বালিয়ে দিন। সম্ভব হলে ফুল নিবেদন করতে পারেন। তবে গাঁদা ফুল দেবীকে অর্পণ করবেন না। এই সবকিছুই অতি শ্রদ্ধার সঙ্গে করতে হবে ।
মাটিতে অথবা সোজা হয়ে বসা যায় এইরকম চেয়ারে বসুন। যদি চেয়ারে বসেন তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন যাতে পায়ের পাতা মাটি কে স্পর্শ করে। এইবার দুইহাত কোলের উপর রেখে শ্রী মাতাজী র ছবির দিকে প্রসারিত করে বসুন এবং চিত্ত সহস্রারে নিবদ্ধ রেখে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকুন। মায়ের কাছে প্রার্থনা করুন_ "মা কৃপা করে আপনার প্রেম শক্তি আমার মধ্যে প্রবাহিত হোক" ক্রমে আপনি অনুভব করবেন যে হাতের তালু ও মাথা য় শীতল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে এবং আপনি চিন্তার স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্বিচারে পৌঁছে যাচ্ছেন। এই অবস্থার চোখ বন্ধ করে ধ্যানের শান্তিকে 10 থেকে 15 মিনিট উপভোগ করুন। এইভাবে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় ধ্যানে বসা আবশ্যক । কখনো কখনো এই বায়ু উষ্ণ হতে পারে অথবা বাম ও ডান হাতে সমানভাবে অনুভূত নাও হতে পারে। সমানভাবে দুইহাতে এবং মাথায় শীতল স্পন্দন বুঝতে হলে ইড়া পিঙ্গলা নাড়ীকে সমতায় আনা প্রয়োজন।
ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ীর সমতা বিধান ( চিত্র - ৩ ক ও খ)
বামহাত টি উন্মুক্ত অবস্থায় মায়ের ছবির দিকে প্রসারিত করুন , আঙ্গুল গুলির মধ্যে ফাঁকা বজায় রাখুন । ডান হাতের তালু সম্পূর্ণ মাটিতে স্পর্শ করে রাখুন নতুবা (চেয়ারে বসলে) মাটির দিকে রাখুন । শ্রী মাতাজির নিকট প্রার্থনা করুন “মা আমার শরীরের বাম দিকের সকল বাধা আপনার কৃপায় যেন ধরিত্রী মাতা শোষণ করে নেন” এই অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকুন । এরপর ডান হাত শ্রী মাতাজী র ছবির দিকে উন্মুক্ত করে প্রসারিত করুন এবং বাম হাতের তালু পিছন দিকে রেখে আকাশের দিকে তূলে ধরুন , প্রার্থনা করুন- “মা কৃপা করে আমার ডান দিকের সকল বাধা দুর করে দিন” । কিছু সময় এইভাবে থাকার পর দুই হাত কোলের উপরের নামিয়ে আনুন । লক্ষ্য করুন, শীতল স্পন্দন এবার আপনার শরীরে শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং আপনি ক্রমশ নির্বিচারের স্তরে পদার্পণ করছেন । এমতাবস্থায় ধ্যানের আনন্দ উপভোগ করুন ।
সামুহিকতায় ধ্যান -
প্রতিটি সহজযোগী / যোগিনী র মনে রাখা উচিত যে সপ্তাহে অন্তত একবার সহজ যোগ কেন্দ্রে গিয়ে সামুহিক ভাবে ধ্যান করা আবশ্যক । এ ছাড়া ও এখানে সহজ যোগ সংক্রান্ত নানান তথ্যও সংগ্রহ করতে পারবেন বা প্রয়োজনে অন্যান্য সহজ যোগী ভাই বোনেদের সাহায্য নিতে পারেন । যদি আপনি এমন জায়গায় থাকেন যেখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কোন সহযোগ কেন্দ্র নেই , তাহলে পরিবারের সকল সহজ যোগী একত্রে বসে সপ্তাহে অন্তত একবার ধ্যান করবেন । এবং চেষ্টা করবেন যাতে প্রচারের মাধ্যমে সহজযোগের বিস্তার ঘটে ও নিয়মিত ধ্যান কেন্দ্র স্থাপিত হয় ।
কুণ্ডলিনীর উত্থান ও তার শারীরিক প্রকাশ
অনেক সময় সাধক অনুভব করে যে তার কুণ্ডলিনী ধীরে ধীরে স্থান লাভ করছে । অন্যরাও কখনো কখনো সেই উত্থান দেখতে পায় । প্রথমে ব্রহ্মতালুতে দপদপ ভাব স্পষ্টত অনুভব করা যায় । তারপর এই স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে শীতল বায়ু প্রবাহিত হতে থাকে এবং নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ নিরবতা নেমে আসে । সাধকের চোখের তারা বড় হয়ে যায় এবং চোখে আলোর দীপ্তি দেখতে পাওয়া যায় । তার সমস্ত উত্তেজনা প্রশমিত হয়, মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং শরীর হাল্কা হয়ে যায় । চিত্ত বাইরের জগতের চঞ্চলতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মধ্যে স্থিতি লাভ করে, শান্তি নেমে আসে এবং সাধক অপরিসীম আনন্দের মাঝে প্রবেশ করে ।